ভারী পানি বা ভারী জল (ডিউটেরিয়াম অক্সাইড) কী ? এইটা কীভাবে ব্যবহার হয়?

 

ভারী পানি বা ভারী জলঃ 

পানির বিষয়ে আমরা অনেক কিছুই জানি। কিন্তু ভারী পানির বিষয়ে আমরা খুব কম মানুষই জানি। চলুন, আজকে ভারী পানি সম্পর্কে জানা যাক:

পানিকে ইংরেজিতে বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে । সেগুলো হল WATER, AQUA এবং ADAM'S ALE (ADAM'S ALE অর্থ মূলত 'ভেজালহীন পানি)।আমরা সাধারণত পানির সংকেত H2O বলেই জানি। আসলে আমাদের পানীয় জল তৈরি হয় ২ অনু হাইড্রোজেন ও ১ অনু অক্সিজেন নিয়ে। তবে এই ভারী পানি কি ? 



বিজ্ঞানী হেরল্ড উড়ে (Harold Urey) ১৯৩৩ সালে সর্ব প্রথম সাধারন জল থেকে ভারী জল পৃথক করতে সমর্থ হন এবং ডয়টেরিয়াম আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার এ ভূষিত হন। ভারতীয় বিজ্ঞানী স্যার এইচ. জে. ভাবার( H.J.Bhabha - father of Indian nuclear program ) বলেছিলেন যে, ভারত মহাসাগরে যে অফুরন্ত ভারী জলের ভান্ডার আছে, তা একদিন অফুরন্ত শক্তির উৎস হয়ে দেখা দেবে। তার এ মূল্যবান ভবিষ্যৎ বানীটির গুরুত্ব ততদিন পর্যন্ত বোঝা যায়নি যতদিন পর্যন্ত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া আবিষ্কার হয়নি। কারন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য যে টার্গেট পরমানুর প্রয়োজন তার একমাত্র উৎস হল সমূদ্রের ভারী জল থেকে আহরিত ডিউটেরিয়াম বা ভারী হাইড্রোজেন। সমুদ্রের পানি থেকে আহরিত দশ লিটার ভারী পানিতে যে পরিমান ভারী হাইড্রোজেন (ডিউটেরিয়াম) পাওয়া যায় তা দ্বারা ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো হলে যে পরিমান শক্তি উৎপাদন করা যায় তা অন্য ভাবে উৎপাদন করতে গেলে আনুমানিক তিন হাজার লিটার পেট্রল খরচ করতে হবে।


হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ডয়টেরিয়ামের দুটি পরমাণু ও অক্সিজেনের একটি পরমাণু যুক্ত হয়ে যে সমযোজী যৌগ গঠন করে, তাকে ভারী পানি বা ভারী জল বলে। হাইড্রোজেন (H) প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত ৩টি আইসোটোপ রয়েছে, যা মাঝে মাঝে 1H(প্রোটিয়াম), 2H (ডয়টেরিয়াম)এবং 3H(ট্রিটিয়াম) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অন্যান্যগুলো অত্যন্ত অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াস (4H থেকে 7H), যা গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরী কিন্তু প্রকৃতিতে সংঘটিত হয় না। সবচেয়ে স্থিতিশীল রেডিওআইসোটোপ হল টিট্রিয়াম(3H), যার অর্ধ জীবন ১২.৩২ বছর। সকল ভারী আইসোটোপই কৃত্রিম এবং এক জেপ্টোসেকেন্ডের (১০−২১ সেকেন্ডে) চেয়েও কম অর্ধ জীবন রয়েছে। যার মধ্যে 5H হল সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং সবচেয়ে কম স্থিতিশীল আইসোটোপ হল 7H।  ডয়টেরিয়াম কে D দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং ট্রিটিয়াম কে T দ্বারা প্ৰকাশ করা হয়।  উক্ত প্রকৃতি নির্মিত তিনটি সমস্থানিকই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে অক্সাইড গঠন করে। যথা: H2O , D2O, T2O  এই D2O ভারী জল বা পানি বলে পরিচিত।

১ লক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে মাত্র ১৫টি ডিউটেরিয়াম পরমাণুর আইসোটপ পাওয়া যায়। আর এই আইসোটপ যখন অক্সিজেনের সাথে মিশে জল উৎপন্ন করে তাকে ভারী জল বলে। ভারী জল দেখতে সাধারন পানির মত। তবে সাধারন জলের চেয়ে ভারী কারণ এটিতে সাধারণ হাইড্রোজেনর থেকে একটি বেশি নিউট্রন বিদ্যমান থাকে।

প্রকৃতিতে ভারী জল একক ভাবে বিরাজ করে না। সাধারন জলের সাথে মিশে থাকে। বৃষ্টির জল, পুকুর, নদী, খাল, নলকূপ, কূয়া, সমুদ্রের জলের সাথে মিশে থাকে। তবে নদী বা সমুদ্রের ০.০১৫ শতাংশ জলই ভারী জল। নলকূপ কুয়া পুকুরের পানিতে প্রতিটনে থাকে দুইশ গ্রাম হতে আড়াইশ গ্রাম। ভারী পানি সাধারন পানির মতই গন্ধহীন বর্ণহীন স্বচ্ছ। এর পৃথক প্রণালী খুব সহজ। স্বাভাবিক তড়িৎ বিশ্লেষণ ও পাতন প্রক্রিয়ায় আলাদা করা যায়। বার বার পাতন করে প্রায় ৯৯% ভারী পানি পাওয়া যায়।

বৈশিষ্ট্য :

  • এই জলের ঘনত্ব সাধারণ জলের থেকে কিছুটা বেশি।  
  • এর আণবিক ভর 20 । ভারি জল তীব্র জলাকর্ষী। এটি প্রাকৃতিক জলের নমুনাকে পুনঃপুনঃ তড়িৎবিশ্লেষণ করলে এটি পাওয়া যায়।  
  • এই জলে বীজ অঙ্কুরিত হয় না। স্নান করলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।  
  • নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে কুল্যান্ট রূপে ব্যবহৃত হয়।

ভারী জলের ব্যাবহার : 

  • ভারী হাইড্রোজেনের বা ডিউটেরিয়াম এর একমাত্র উৎস এই ভারী পানি। 
  • সরাসরি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরে কুলেন্ট হিসেবে ভারী পানি ব্যাবহার হয়। 
  • চুল্লি থেকে গামা রশ্মির বহির্গমন রোধ করতে ভারী পানি ব্যাবহার হয়। 
  • আনবিক বোমা তৈরীতে প্রয়োজনীয় ডিউটোরিয়ামের লিথিয়াম যৌগ ভারী জল হতে পাওয়া যায়। ভারী জল হতে উদগিরীত আনবিক শক্তি ইউরেনিয়াম থেকে অনেক বেশি ।সাধারন ভাবে প্রতি টন ইউরেনিয়াম-২৩৫(U235) নামক মৌল থেকে যেইখানে ২০ মেগা টন শক্তি পাওয়া যায় সেখানে ভারী পানি থেকে উৎপাদিত লিথিয়াম-ডয়টেরাইড যৌগ থেকে পাওয়া যায় প্র‌ায় ৬০ মেগা টনের মত।
তাই এনার্জি বা পাওয়ার সেক্টরে ভারী পানির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এই ভারী জলই একদিন পৃথিবীর মহাশক্তির উৎস হবে। যথোপযুক্ত প্রযুক্তি আর প্রয়োগের মাধ্যমে ভারী পানির উৎস খুজে আমরাও ভারী পানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url